আজকে যে টি২০ খেলাটা হয়, সেটা তিনি আরো ৩০ বছর আগেই খেলে এসেছেন

 সম্প্রতি এক ইন্টারভিউয়ে সাবেক লেফট আর্ম স্পিনিং অল-রাউন্ডার রফিক বলেছেন যে আজকে যে টি২০ খেলাটা হয়, সেটা তিনি আরো ৩০ বছর আগেই খেলে এসেছেন! কথার সাথে কে কদ্দুর একমত হবেন জানিনা, আমি শতভাগ একমত।

সেই আমলে এইরকম ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা প্লেয়ার বাংলাদেশে বিরলই ছিলো। যেটা বলেছেন, এই ফ্রাঞ্চাইজির যুগে সাকিব থেকেও বেশি কামাতে পারতেন, সেটা হয়তো হতো, নয়তো না। তবে উনার কথার পয়েন্ট অনুযায়ী তিনি ঠিকই ছিলেন।
মোহাম্মদ রফিকের ক্যারিয়ার নিয়ে ছোট করে অনেকগুলো স্ট্যাট দিবো, অনেকগুলো ম্যাচের কথা বলবো, ধৈর্য হারাবেন না। আশা করি ভালো লাগবে। তার আগে বলে নেই, রফিক কিন্তু মূলত লেফট আর্ম স্পিনার এবং লোয়ার অর্ডার ব্যাটার (যদিও দলের প্রয়োজনে সব জায়গায় খেলেছেন), এই পোস্টে আমি কিংবদন্তি লেফট আর্ম স্পিনার রফিকের বোলিংয়ে আলোকপাত করবো না, স্ট্যাটপোস্টিং পুরোটা হবে ব্যাটিং নিয়ে।
🟢 টেস্ট:
➡️ বাংলাদেশ ম্যাচ হারেনি, অর্থাৎ ড্র করেছে বা জিতেছে এমন ম্যাচে রফিকের গড় ৬২.৮০! আবারও বলছিল, গড় ৬২.৮০! রফিকের চেয়ে বেশি গড় আছে কেবল মুমিনুল(৭২.৬৪) ও শান্ত(৬৫.৪৬) এর। রেকর্ডটা সমীহ করার মত নয় কি?
রফিক আছেন, এমন ১ টি টেস্ট বাংলাদেশ জিতেছে, ও ৪ টায় ড্র, ওই পাঁচ ম্যাচের স্কোর রফিকের:
- ২৬* বনাম জিম্বাবুয়ে (বুলাওয়ে, ২০০৪, বৃষ্টি কবলিত ড্র)
- ১১১ ও ২৯ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (গ্রস আইলেট, ২০০৪, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম অর্জিত ড্র)
- ৬৯ ও ১৪* বনাম জিম্বাবুয়ে (চট্টগ্রাম, ২০০৫, ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়)
- ৫৬ বনাম জিম্বাবুয়ে (ঢাকা, ২০০৫, ড্র করে সিরিজ জয় নিশ্চিত করে)
- ৯ বনাম ভারত (চট্টগ্রাম, ২০০৭, বৃষ্টি কবলিত)
অর্থাৎ বাংলাদেশ হারেনি এমন ম্যাচগুলোতে রফিক কম যান নি ব্যাট হাতে। বরং ইতিহাসের প্রথম কষ্টার্জিত ড্র তে করেছে সেঞ্চুরি, লোয়ার অর্ডারে নেমে। প্রথম জয়েও করেছে ৬৯*, এনামুল জুনিয়র দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট না নিলে হতে পারতেন ম্যাচসেরা।
➡️ টেস্টে রফিকের আরেকটা রেকর্ড বলি। তামিম টেস্টে ২০৬ করতে ৭ ছক্কা মারেন যেটা এখন টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ড। তামিমের আগে এই রেকর্ডটি কিন্তু ছিল রফিকের দখলেই। প্রতিপক্ষ কে অনুমান করতে পারেন? প্রতিপক্ষ ছিলো মাইটি অস্ট্রেলিয়া। লি, ওয়ার্ন, ম্যাকগিলদের বিপক্ষে সেদিন রফিক করে ৫৩ বলে ৬৫! ৫৩ বলে ৬৫ করতে তিনি হাঁকান ৬ টি ছক্কা!
➡️ টেস্টে রফিক শেষ ম্যাচ খেলে ২০০৮ এ! সে পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে বেশি ছক্কা মারেন এই বোলার রফিক (৩৪ টা)
🟢 ওয়ানডে:
➡️ বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয় আসে কেনিয়র বিপক্ষে, ১৯৯৮ সালে। সেই ম্যাচে ম্যাচসেরা এই রফিকই। বোলার রফিক সেদিন বল হাতে ৩ উইকেট নেন, আবার ২৩৭ চেজ করতে নেমে ওপেনিং এ ৮৭ বলে ৭৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন! তাই প্রথম জয়ের নায়ক যে রফিক, এতে তো সন্দেহর অবকাশ নেই-ই!
➡️ এছাড়া ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ সিরিজের সিরিজ ডিসাইডার পঞ্চম ম্যাচে ১৯৯ রান তাড়া করতে ওপেনিংয়ে নামেন রফিক, সেখানে ৬৬ বলে ৭২ করে ম্যাচসেরা হন রফিক। বলে রাখা দরকার, এটাই কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়!
➡️ ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৭ বলে ৯*; হাসতে পারেন, এটা কেনো বলছি? এটা ধরে নেন একটু আবেগের জায়গা থেকেই বলা, কারণ সেই জয়টা আমার কাছে বরাবরই প্রিয়। আশরাফুল আউট হওয়ার সময়ও বাংলাদেশের ৮ করে রান লাগতো শেষ ৩ ওভারে (২৩/২৪ এর মত)। তখন নেমেই প্রেশার সিচুয়েশনে নিজের ফেইস করা প্রথম বলে চার মেরে রফিক কিন্তু সেই ব্যাটিং সক্ষমতার জানান দেন!
➡️ ওয়ানডেতে শেষ ম্যাচ খেলেন ২০০৭ এ, সেই পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারে আফতাব, ৪৬ টা, দ্বিতীয় নামটাই, এই বোলার রফিকের: ২৯ টা।
উল্লেখ্য, জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলার পর তিনি এশিয়া একাদশের হয়ে আফ্রিকা একাদশের বিপক্ষে ওয়ানডে খেলেন, যেটাও আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
🟢 টি২০
- খেলেছেনই ১ টা। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম টি২০ ম্যাচ ছিল সেটা৷ ব্যাট হাতে সেদিনও করেছেন ৫ বলে ১৩! ইন ফ্যাক্ট, তিনি বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার, যিনি নিজ দেশের তিন ফরম্যাটেরই প্রথম জয়ে সাক্ষী ছিলেন।

৩ ফরম্যাট গেলো, কিন্তু উনাদের কি আপনি ৩ ফরম্যাটের মাপকাঠিতে মাপতে পারবেন? উনারা তো একটা সময় লড়াই করতো বাংলাদেশ যেন ফরম্যাটগুলো খেলতে পারে, জাতীয় দলের হয় অন্যদেশের সাথে খেললেও সেই ম্যাচগুলোর ছিল না আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস। তাই ক্রিকবাজে সেই তথ্য পাবেন না।
➡️ আইসিসি ট্রফি ফাইনাল, ১৯৯৭! নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই৷ যেটি জিতে বলেই বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের দাবি জোড়ালো হয়, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের টিকিট যদিও সেমি জিতে পায়, তবু এই ফাইনাল জিতাটা বাংলাদেশের জরুরি ছিল! বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে বাংলাদেশের সেদিন ২৫ ওভারে ১৬৬ লাগতো। প্রথম বলে উইকেট যাওয়ার পরেও ওপেনিংয়ে নামা রফিকের কাউন্টার এটাকিং বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছিলো। দলীয় ৫০ রানে আউট হওয়ার আগে রফিক করেছিলেন ২ চার, ২ ছক্কায় ১৫ বলে ২৬!
এই বিষয়গুলোই তো আসলে ইমপ্যাক্ট! যেই "ইম্প্যাক্ট" শব্দটা আমরা সমর্থকরা শিখেছি কয়ে বছর হলো, সেই ইমপ্যাক্ট রফিক আসলেই ৩০ বছর আগেই খেলে আসছেন। তাই এই যে তিনি বললেন, যে টি২০টা উনি আগে থেকেই খেলেন সেটা কোনো অংশেই ভুল না।
➡️ চোখ কপালে উঠার মত আরেকটা ইনফো হলো, মোহাম্মদ রফিক তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে চার নাম্বারে কখনো ব্যাট করে নি, এই টু ডাউন বা ৪ নাম্বার বাদে, যে ১০ টা ব্যাটিং পজিশন আছে; ওপেনিং, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ - সব পজিশনে ব্যাট করেছে রফিক।
"Khelar Mathe" কে দেওয়া ওই ইন্টারভিউ তে রফিক আরো বলেন উনি আর মাশরাফি বাংলাদেশকে লোয়ার অর্ডারে যে সাপোর্টটা দিয়েছে, এখন বাংলাদেশকে ওই সাপোর্টটা কেউ দিতে পারেনা। এই কথাতেও আমি অন্তত দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ পাই না। সেসময় রফিক-ম্যাশ তো বটেই, তাপস বৈশ্য, শাহাদাতরা টুকটাক হেল্প করতে পারতো, এখনকার লোয়ার অর্ডাররা যেটা পারে না, তাইজুল ব্যতীত।
ওই যুগের পোস্টার বয় আশরাফুল, তরুণ তুর্কী আফতাব, কাপ্তান বাশার কিংবা তারও আগে দূর্জত-বুলবুল-নান্নু-আকরামরা থাকলেও, বোলার রফিকের ব্যাটিংটা ছিলো এঞ্জয় করার মত!

Post a Comment

0 Comments