পৃথিবীতে নানা ধরনের বিপজ্জনক প্রাণী রয়েছে যেগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে থাকে। এদের মধ্যে কিছু প্রাণী সরাসরি আক্রমণ করে, আবার কিছু প্রাণী তাদের বিষাক্ত দাঁত বা অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। আজ আমরা বিশ্বের এমন দশটি বিপজ্জনক প্রাণীর সম্পর্কে জানবো যারা মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
১. মশা (Mosquito)
মশা ছোট হলেও অত্যন্ত বিপজ্জনক। তারা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকুনগুনিয়া সহ বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। প্রতি বছর প্রায় ৭০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় মশার কারণে। মশা বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস এবং পরজীবী বাহক হিসেবে কাজ করে, যা মানুষের রক্তে প্রবেশ করে এবং নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। মশার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা। মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষের অনেক সচেতন হওয়া প্রয়োজন এবং মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি উদ্যোগ বাড়ানো দরকার।
২. সাপ (Snake)
বিশ্বে প্রায় ৬০০ প্রকারের বিষাক্ত সাপ আছে। এর মধ্যে কিছু সাপের কামড় সরাসরি প্রাণঘাতী হতে পারে। প্রতি বছর প্রায় ১০০,০০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। বিষাক্ত সাপের মধ্যে ব্ল্যাক মাম্বা, কিং কোবরা, র্যাটলস্নেক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাপের বিষ মূলত স্নায়ু বা রক্ত সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করে যা সময়মতো চিকিৎসা না করলে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে এবং সাপের উপস্থিতি টের পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. কুকুর (Dog)
যদিও কুকুর মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে পরিচিত, তবে পাগল কুকুরের কামড়ে প্রতি বছর প্রায় ২৫,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়, মূলত র্যাবিস সংক্রমণের কারণে। র্যাবিস একটি মরণব্যাধি রোগ যা আক্রান্ত কুকুরের কামড় থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। একবার র্যাবিসের লক্ষণ দেখা দিলে, এটি প্রায় সবসময়ই মরণশীল হয়। তবে র্যাবিস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। পোষা কুকুরের সঠিক যত্ন এবং নিয়মিত ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো যায়।
৪. টিসি মাছি (Tsetse Fly)
এই মাছি আফ্রিকায় প্রচুর দেখা যায় এবং এরা ট্রাইপানোসোমা প্রজাতির পরজীবী ছড়ায়, যা ঘুমের রোগ (স্লিপিং সিকনেস) সৃষ্টি করে। প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে এদের কারণে। এই রোগটি মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি আক্রান্ত ব্যক্তির কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে, যার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত, আচরণের পরিবর্তন এবং অচেতন অবস্থা সৃষ্টি হয়। টিসি মাছি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এলাকায় মাছি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
৫. ফ্রেশওয়াটার শামুক (Freshwater Snail)
এরা শিস্টোসোমিয়াসিস নামক পরজীবী রোগ ছড়ায় যা প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এই পরজীবী শামুক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং লিভার, ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আক্রমণ করে। শিস্টোসোমিয়াসিস রোগটি মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর পানিবাহিত রোগ হিসেবে পরিচিত। নিরাপদ পানি ব্যবহার এবং সঠিক স্যানিটেশনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৬. হিপোপটামাস (Hippopotamus)
এই বিশালাকার প্রাণীটি খুবই আক্রমণাত্মক এবং প্রতি বছর প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। হিপোপটামাস প্রধানত আফ্রিকার নদী এবং হ্রদে বাস করে এবং এরা তাদের এলাকায় আগন্তুক বা হুমকি মনে করলে আক্রমণ করে। হিপোপটামাসের আক্রমণে মানুষের গাড়ি বা নৌকাও উল্টে যেতে পারে। এদের থেকে নিরাপদ থাকার জন্য তাদের আবাসস্থল থেকে দূরে থাকা উচিত এবং কোনো ধরনের উস্কানিমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।
৭. কুমির (Crocodile)
কুমিরের আক্রমণে প্রতি বছর প্রায় ১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এরা দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। কুমির সাধারণত নদী, হ্রদ এবং জলাভূমিতে বাস করে এবং শিকার করার সময় অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়। কুমিরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের এলাকায় না যাওয়া এবং জলাশয়ে সতর্কভাবে চলাফেরা করা প্রয়োজন।
৮. নারিকেল (Coconut)
এই অদ্ভুত তথ্যটি শুনতে মজার লাগতে পারে, কিন্তু প্রতি বছর প্রায় ১৫০ মানুষ নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল পড়ে মারা যায়। বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে নারিকেল গাছের নিচে বসা বা ঘুমানোর সময় এই বিপদ ঘটে। নারিকেল পড়ার সময় মানুষের মাথায় আঘাত লাগলে এটি মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই নারিকেল গাছের নিচে সতর্কভাবে চলাফেরা করা উচিত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৯. সিংহ (Lion)
জঙ্গলের রাজা সিংহের আক্রমণে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। সিংহ খুবই শিকারি প্রাণী এবং তারা সাধারণত দলের সাথে শিকার করে। সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জঙ্গল এলাকায় সতর্কভাবে চলাফেরা করা উচিত এবং সিংহের আবাসস্থলে অনুপ্রবেশ না করা উচিত।
১০. বক্স জেলিফিশ (Box Jellyfish)
এই বিষাক্ত প্রাণীটি প্রতি বছর প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এদের বিষাক্ত আক্রমণে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি মরণশীল হতে পারে। বক্স জেলিফিশ মূলত অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এলাকায় পাওয়া যায়। সমুদ্র সৈকতে সাঁতার কাটার সময় এই বিপজ্জনক প্রাণী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্ক থাকা এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা ধরনের বিপজ্জনক প্রাণী রয়েছে, যারা আমাদের জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। আমাদের সকলের উচিত এদের সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের জন্য এই প্রাণীদের সম্পর্কে জ্ঞান এবং সতর্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য আমাদের সকলেরই এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।
0 Comments